FB!

Saturday, November 12, 2016

সিলেট থেকে কক্সবাজার হঠাৎ বান্দরবন

সিলেট থেকে কক্সবাজার
সিলেট থেকে সরাসরি কক্সবাজার যেতে চাইলে উঠতে হবে বাসে, আর বাসের কষ্ট করতে না চাইলে প্রথমে ট্রেনে করে আপনাকে যেতে হবে চট্টগ্রাম, তারপর চট্টগ্রাম থেকে বাস অথবা প্লেনে কক্সবাজার। কিন্তু যাওয়ার আগেই ঠিক করে নিন কতদিন থাকবেন এবং কোথায় থাকবেন। বড় কোন সরকারি ছুটি থাকলে অবশ্যই আগে থেকে হোটেল বুক করে রাখবেন (অন্তত ১মাস আগেই), আর সাধারণ খোলার দিনগুলোতে বুকিং ছাড়া যাওয়াই ভাল তবে আগে থেকে কয়েকটা হোটেলের নামের তালিকা নিয়ে যাবেন যাতে বেশি খোঁজাখুজি করা না লাগে। আমি কক্সবাজার যাব আর বীচের থেকে দূরে থাকব সেটা মেনে নিতে পারি না, তাই বীচের ধারের হোটেলগুলোই আমার পছন্দ। এখন তো লাবণী থেকে কলাতলী পুরো বীচের কাছেই কত হোটেল (Google Map দেখে নিতে পারেন)। 

রাতে সিলেট থেকে রওনা হয়ে কক্সবাজার পৌঁছাতে হয়তো ১১/১২টা বেজে যেতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব হোটেল এ চেক-ইন করুন (ব্যাস্ত সময়ে ১১.৩০টার আগে সাধারণত রুম ফ্রি পাওয়া যায়না)। তারপর কাপড় পালটে চলে যান সমুদ্র স্নানে। সমুদ্রে নামার সময় খালি হাত-পা নিয়ে যান। টাকা, মোবাইল, স্যান্ডেল রাখার চিন্তায় আনন্দ মাটি করার কোন মানে হয়না। মনে রাখবেন, স্যান্ডেল কেউ পাহারা না দিলে হয় সমুদ্র ভাসিয়ে নেবে নয়তো অন্য কেউ (আমার সদ্য কেনা স্যান্ডেল জোড়া হারিয়ে এসেছিতো!)। সমুদ্র জলে ভিজে আপনার ভ্রমণের সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে, উপভোগ আর উপলব্ধি করলাম সমুদ্রের বিশালতা। সমুদ্র থেকে ফিরে গোসল করে, তারপর খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিলাম। ঘুম থেকে উঠে আবার গেলাম সমুদ্রে। ঐ দিন সিগন্যাল থাকার কারণে সাগর ছিল উত্তাল, এ যেন আরেক উন্মাদনা।হাঁটলাম লাবণী বীচ থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত। ঘুরে দেখলাম আশে পাশের এলাকা।

পরদিন ভোরে উঠে রওনা দিই  ইনানী বীচের উদ্দেশ্যে। কলাতলী মোড় থেকে লোকাল কিংবা রিজার্ভ জীপে করে যাওয়া যায় তবে আমরা গিয়েছিলাম সিএনজি অটোতে, সারাদিনের রিজার্ভ। ইনানী বীচে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ফিলিংস পাওয়া যায় কেননা এই বীচে আছে অসংখ্য প্রবাল পাথর, আর মন ভাল করে দেয়ার কোন অদেখা কিছু। কক্সবাজার থেকে ইনানী যাওয়ার পথে পরে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান। তাই ইনানী থেকে ফেরার পথে হিমছড়ি দর্শন । একপাশে পাহাড় আর অন্য পাশে সাগর আর সেটাও বাংলাদেশে আর হিমছড়িতেই আপনার সেই ইচ্ছা পূরণ হবে। হিমছড়ির চূড়া থেকে দেখলাম নীল সাগরের বিশালতা। আর চাইলে দূরবীন দিয়ে দেখা যেত আরও অনেক দূর । পাহাড় থেকে সমুদ্র দর্শন শেষে নীচে নেমে বাঁ দিকের রাস্তায় আছে একটি ঝর্ণা, ভরা বর্ষায় যৌবনা হলেও আমি যখন দেখেছি সেটাকে মিনি ঝর্ণা বলাই ভাল।ও হ্যাঁ যে পথ ধরে ইনানী যেতে হয় সেটা কিন্তু একদম সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে মেরিন ড্রাইভ রোড তাই পুরোটা রাস্তায় সমুদ্র  যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাহাড় আর সমুদ্রের মাঝ দিয়ে ছুটে চলা এ যে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। ফিরে এসে আমরা সন্ধ্যার সমুদ্র দেখলাম, রক্তিম সূর্যটা রক্তরাঙা রঙে রাঙিয়ে দিল পুরো আকাশটাকে। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য। পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসলাম হোটেলে।  আবারো,রাতের খাবার খেয়ে আবারো যান সমুদ্র তীরে। এবার বসুন সমুদ্রের পাড়ে রাখা বেঞ্চগুলোর একটি, জোছনা রাতে এর থেকে উপভোগ্য কিছু হতেই পারে না। আমার দেখামতে, রাতের বেলায়ও বেশ নিরাপদ বলব কেননা আমরা রাত ১২.০০টার সময় রুমে ফিরেছি তখনও প্রচুর মানুষ ছিল বীচে ও রাস্তায়। 

কক্সবাজারে সূর্যাস্ত



কোথায় খাবেনঃ 
কক্সবাজারে প্রায় প্রতিটি হোটেলের সাথেই আছে রেস্টুরেন্ট। এর বাইরেও আছে আরও কিছু রেস্টুরেন্ট যেগুলোতে দেশীয় ভিন্ন খাবারের পাশাপাশি পাওয়া যাবে সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছের মেন্যু। তন্মধ্যে উল্লেখ্য চিংড়ি, লইট্টা, ছুড়ি মাছের ভর্তা, রূপচাঁদা ভূনা/ফ্রাই । দাম রেস্টুরেন্ট ভেদে ভিন্ন হতে পারে। নিউ বীচ রোডের ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্ট-এ রাতের খাবারটা ভাল ছিল। এছাড়াও মারমেইডের একটি ক্যাফে আছে সুগন্ধা পয়েন্টে (পকেট অতিরিক্ত গরম থাকলে ও ভাল ধৈর্য থাকলে এটি রোমান্টিক সময় কাটানোর জন্য উত্তম স্থান)। আর ইনানী থেকে ফেরার পথে হিমছড়িতে আছে কয়েকটি রেস্তোরা যেখানে দুপুরের খাবার বেশ ভালই। সি শাইন ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদ এখনো জিভে লেগে না থাকলেও মনে আছে। দামও সীমিত পরিবেশন ও চমৎকার। হিমছড়ি পাহাড়ে উঠার আগে অর্ডার করে গেলে এসেই খেতে পারবেন না হলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কেননা ওরা বেশ কিছু আইটেম রান্না করে শুধু অর্ডার পেলেই শুধুই আপনার জন্য। 
ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্ট এর রূপচাঁদা ফ্রাই
হিমছড়ির সি শাইন রেস্তুরার চমৎকার পরিবেশনা






কোথায় কোথায় ঘুরবেনঃ
লাবণী বীচ, কলাতলী বীচ, ইনানী বীচ, হিমছড়ি, রামু, ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, সময় থাকলে সেন্টমার্টিনের জন্যও আলাদা প্ল্যান রাখতে পারেন।
হিমছড়ি  
ইনানী
 
               

কেনাকাটাঃ
কক্সবাজারে গিয়ে কেনাকাটা করবেন না তা তো হতে পারে না। বার্মিজ মার্কেট, ঝিনুক মার্কেট, এছাড়া বীচের পাড়ে আরও কয়েকটি মার্কেট গড়ে উঠেছে।

বীচ ফটোগ্রাফীঃ
ছবি তোলার জন্য এখন আর তৃতীয় ব্যক্তিকে সঙ্গে নিতে হবে না। বীচেই পেয়ে যাবেন অসংখ্য ফটোগ্রাফার, দরদাম ঠিক করে তারপর ছবি তুলোন, ছবির সংখ্যা নির্ধারণ করে দিন, নিশ্চিন্তে ছবি তুলোন আপনার হোটেল-এ ছবি পৌঁছে দিয়ে আসবে ফটোগ্রাফার। 

হঠাৎ বান্দরবন
কক্সবাজার থেকে বান্দরবন যাওয়াটা অনেক সহজ। কক্সবাজার বাস স্টেশন থেকে আধা ঘন্টা পরপর পূরবী/পূর্বাণী নামের বাস ছেড়ে যায় বান্দরবনের উদ্দেশ্যে, সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা। বান্দরবন শহরে ও এর আশপাশে এখন অসংখ্য হোটেল আছে তাই আগে থেকে বুকিং না দিলেও চলে, তবে নিশ্চিত থাকতে চাইলে অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখতে পারেন। সকাল সকাল কক্সবাজার থেকে রওনা হয়ে বান্দরবন পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ি শহরের নিকটবর্তী পর্যটন স্পটগুলো দেখতে। মানুষ বেশি থাকলে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করতে পারেন। না হলে আমাদের মত সিএনজি রিজার্ভ করতে পারেন, ৮০০ টাকায় মেঘলা, নীলাচল আর রূপালী-রূপসী ঝর্ণা। আমরা প্রথমেই চলে যাই ঝর্ণা দুটোয় ওখান থেকে মেঘলা। মেঘলা হচ্ছে বান্দরবন জেলা প্রশাসন পরিচালিত একটি অপূর্ব সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র। পাহাড়ের খাদে বাঁদ দিয়ে কৃত্রিম লেক আর তার উপর দুটো ঝুলন্ত ব্রিজ, আরো আছে রোপ কার, মিনি চিড়িয়াখানা আরও কত কী! 
রূপালী ঝর্ণা
মেঘলায় ক্যাবল কার

এরপর নীলাচল, এটিও জেলা প্রশাসনের অধীনে,  শহর থেকে মাত্র ৪ কিমি দূরে প্রায় দুই হাজার ফুট উঁচু নীলাচল। নীলাচল থেকে পুরো বান্দরবন শহরটাকে দেখা যায়। চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ আর আঁকা-বাঁকা পথ আপনার মন ভুলিয়ে দেবে। বিকেলে মধ্যে শহরে পৌঁছে খাবার খেয়ে সামান্য বিশাম নেই আমরা। রাতের বেলায় সাঙ্গু নদীর ব্রীজ, ওপারের সেনা ক্যান্টনমেন্ট, ও তাদের  সিয়েরা লিওনের বিশেষ খাবার অস্কার পুলে সাথে বসনিয়ান পরাটা, আহা! 
নীলাচল
অস্কার পুলে ও বসনিয়ান পরাটা


বান্দরবন বেড়াতে গিয়ে নীলগিরি যায়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল আর তাই আমরাও যথারীতি পরদিন ভোরবেলায় রওনা দিলাম নীলগিরির উদ্দেশ্যে। (উল্লেখ্য, আমাদের বুকিং ছিল একদিনের জন্য তাই ভোরেই চেক আউট করে জিনিসপত্র রিসিপসনে রেখে যাই)  মানুষ বেশি থাকলে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ অথবা কম হলে অন্যদের সাথে মিলেমিশে যাওয়া যায় যেটা নিরপদ ও সাশ্রয়ী। লোকাল বাসেও যাওয়া যায় তবে সময় বেশি লাগে। আমরা গিয়েছিলাম সিএনজিতে(যে ড্রাইভার নিয়ে আগের দিন ঘুরেছি তাকে নিয়েই), ব্যাপারটা অনেক ভয়ংকর সুন্দরের মত। দিনের আলো ফোঁটার আগেই আমরা রওনা হই, পাহাড়ের পাশ কেতে বানানো আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে ছুটতে থাকে আমাদের ত্রিচক্রযান। আমরা ছাড়া তখনো রাস্তায় বের হয়নি কেঊ। সর্পিল পথ ধরে এগুতে এগুতে এক সময় মেঘের নীচ থেকে উঁকি দেয় সূর্য। এযেন নতুন এক সূর্যোদয়। মেঘের কোলে ঘুমানো সূর্য যেন জেগে উঠে নতুন ভোরে। যত পথ এগুচ্ছি ততই বাড়ে উচ্চতা, মাঝে মাঝে উচ্চতা বাড়ে-কমে। পথিমধ্যে ওয়াই ক্রসিং-এ সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নাম নিবন্ধন করতে হয়। তারপর আবার এগুতে থাকা। প্রায় ২ঘন্টা পর আমরা পৌঁছাই অপরূপ সুন্দর নীলগিরি। চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘমালা। যতদূর চোখ যায় সাদা মেঘ, এ যেন অন্য এক সমুদ্র, মেঘের সমুদ্র। নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রটি সেনাবাহিনী পরিচালিত, এখানে থাকার ব্যবস্থাও আছে তবে ৩-৪মাস আগে বুকিং দিতে হয়। এবার ফেরার পালা,  ফিরতি পথে চিম্বুক পাহাড় আর শৈলপ্রপাত ঘুরে আসি। চিম্বুক বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু পাহাড় হলেও যাওয়া যায় গাড়ী নিয়েই, ফলে সৌন্দর্য উপভোগ করতে তেমন কষ্ট করতে হয় না। বিখ্যাত শৈলপ্রপাতটি বান্দরবন থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরে হওয়ার আর তার স্বচ্ছ হিমশীতল জলের টানে পর্যটকদের ভীড় লেগেই থাকে। তবে সাবধান, এখানে পানিতে না নেমে সৌন্দর্য উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কেননা শৈলপ্রপাতটি পাথুরে এবং অনেক পিচ্ছিল, যথেষ্ট সাবধান থাকলেও ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। আমার সামনেও ঘটেছিল একটি, আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে গেছে ভদ্রলোক কিন্তু সবার এমন ভাগ্য নাও হতে পারে। যা হোক বান্দরবন ফিরে হোটেল-এ এসে চেক-আউট রুমের চাবি নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাসে করে চট্টগ্রাম। পরদিন সকালে ট্রেনে করে সিলেট, টিকেট অনলাইনে কেটে রেখেছিলাম আগেই।

মেঘের সমুদ্র, নীলগিরি
নীলগিরি
  
                     

কোথায় থাকবেনঃ
বান্দরবন শহরে থাকার জন্য এখন মোটামুটি মানের অনেক হোটেল আছে (এক্ষেত্রেও Google Map দেখে নিতে পারেন)।  এর বাইরে আছে পর্যটন মোটেল, হলিডে ইন সহ আরও কয়েকটি বিলসাবহুল কমপ্লেক্স।নীলগিরিতে থাকার জন্য আছে বেশ কয়েকটি কটেজ যেগুলো ৩-৪ মাস আগে বুকিং দিতে হয়। আমি থেকেছিলাম বাস স্ট্যান্ডের কাছে যাতে যাতায়ত এর ব্যাপারটা নির্বিঘ্ন হয়, আইডিয়াটা কাজের ছিল বলেই মনে হয়। 

 কোথায় খাবেনঃ 
বান্দরবনে মোটামুটি মানের রেস্টুরেন্ট আছে কিছু, তারমধ্যে তাজিংডং উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে ক্যান্টনমেন্টের পাশে কিছু ক্যাফে আছে। আর নীলগিরিতে বুকিং থাকলে ওখানে বেশ ভাল খাবারের ব্যবস্থা আছে। বুকিং ছাড়া পর্যটকদের হিসেবে নীলগিরিতে ভুনা খিচুড়ি পাবেন, ভালই। 

কেনাকাটাঃ
বান্দরবন শহরে বেশ কিছু দোকানে আদিবাসি কাপড়-চোপড় পাওয়া যায় (বিশেষ করে থানার আশে-পাশে)।বান্দরবন সেনা রিজিওনের সামনেও কিছু দোকান আছে।  চিম্বুক ও শৈলপ্রপাতে কিছু আদিবাসি দোকান আছে। স্থানীয় ফল কিনতে পারবেন নীলগিরি, চিম্বুক কিংবা রাস্তায় পাশে বিভিন্ন জায়গায়।

-রেজা আহমেদ, ব্যাংকার